ফিরে এসো – লেখক সুলেখা আক্তার শান্তা (পর্ব ৭)
বিনোদন ডেক্স
লেয়া একটা মুচকি হাসি দিলো। রবিনের কাকুতির কাছে তার বাবার মন গললো না। যাবার সময় রবিন বলল, বাবা তোমাকে একটা কথা বলে যাই, আজ তোমার সব আছে তারপরও তুমি বলছো তুমি শূন্য তোমার কাছে টাকা নেই। বাবা তোমার কাছে থাকতেও বলছো নেই। বাবার কাছ থেকে চোখের অশ্রম্ন নিয়ে যাচ্ছি, তুমি ভালো থাকো বাবা, তুমি ভালো থাকো। রবিন হাসপাতালে ফিরে এলো। এসে দেখল, তার মায়ের মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা। মাকে ডাকলো, মা মা বাবা আমাকে টাকা দেয়নি। আমি কি তোমার চিকিৎসা করাতে পারব না? এমন সময় শাহানার মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরে যায়। রবিন কেঁদে দেয় মায়ের মৃত মুখ দেখে। মা তুমি কথা বলছ না কেন? ছেলের কথা শুনছো?
একজন ডাক্তার তার মাথার উপর হাত বুলিয়ে বলে, তুমি শান্ত হও, তোমার মা আর নেই।
রবিন মায়ের গায়ের উপর আছড়ে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, মা তুমি ফিরে এসো। এই ছিল আমার মায়ের কপালে! মৃত্যুর সময় ছেলেকে পাশে পেল না। রবিনের করুণ কান্নায় ওয়ার্ডের সবাই জড়ো হয়ে গিয়েছিল। রবিনের কান্না দেখে সবার চোখে পানি এসে গেল। সবাই শান্তনা দিল। রবিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তোমার আদরের ছেলেটাকে কার কাছে রেখে গেলে? তোমার সাথে নিয়ে যেতে পারলে না? মাকে হাসপাতালে থেকে বাসায় নিয়ে গেল। শাহানার মৃত্যুর খবর শুনে রবিনের কলেজের বন্ধু বান্ধবীরা সবাই এলো। রেমাও এলো।
শাহানার লাশ দাফন করা হলো। রবিনের বন্ধু বান্ধবীরা তাকে সান্তনা দিল। তারপর সবাই যার যার মতো চলে গেল। শোকাবহ একটি ঘরে রবিন একা। কিছুক্ষণ পরপর তার বুকফাটা কান্না বেরিয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে বলে— এই একা ঘরে আমি কী করে থাকব মা! তুমি চলে গেলে তোমার ছেলেকে একা করে, এ ঘরে যে আমি থাকতে পারছি না মা। যেদিকে তাকাই শুধুই তোমার স্মৃতি মা। আমি তোমার স্মৃতি নিয়ে থাকব মা।
শোকের তিন দিন পর রবিন তার বাবার কাছে এলো। বাবা বাবা, আমার মায়ের চিকিৎসার টাকা দিবে না? দাওনা বাবা, মায়ের চিকিৎসার টাকা…।
রায়হান বিরক্ত হয়ে বলে, আমি বললাম তো আমার কাছে টাকা নেই। কেন শুধু শুধু জ্বালাতন করছো? এটা অফিস, এখানে এসে ঘেনর ঘেনর করো না…।
রবিন বেদনার বিষণ্ণ হাসি হাসে। তার চোখে পানি। কণ্ঠ আড়ষ্ট। চোখ মুছতে মুছতে বলে, বাবা তোমার টাকা আর লাগবে না, আমার মা আর নেই পৃথিবীতে।
রায়হান বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে রবিনের দিকে। রবিন শান্ত হয়ে বলে, কি বাবা টাকা দিবে না? কথা বলো, চুপ হয়ে আছো কেন? থাক, রেখে দাও বাবা টাকা তোমার কাছে। বাবা তোমার টাকা থাকতেও আমার মায়ের চিকিৎসা হলো না। পারলে না সন্তানের অধিকার দিতে, পারলে না স্ত্রীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। তোমার সব থাকতেও কাউকে কোনকিছু দিতে পারলে না। জানি না, এ তোমার সফলতা না তোমার ব্যর্থতা। আমার মা—ই জয়ী বাবা, কারণ তোমাকে সে তার স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি, করেছ তুমি সর্বক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন। তুমি যেমন তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছ, তেমনি সেও ছিল অনেক অভিমানী। জানো বাবা, তোমার কাছে মায়ের চিকিৎসার টাকা চেয়েছিলাম বলে মা আমাকে রাগ করেছেন। মা এতই অভিমানী ছিল যে, তোমার টাকায় চিকিৎসা করাবে না বলে পৃথিবী থেকে চলেই গেল। ভালো থেকো বাবা, ভালো থেকো।
রবিন বাবার কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। রায়হান পেছন থেকে ডাক দিলো। রবিন পিছন দিকে না তাকিয়ে চলে গেল।
রেমা বলল কেন তুমি নিজেকে এমন দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রাখছ?
আমার চারদিক যে অন্ধকার! আমি যেদিকে তাকাই আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে।
তোমার এ দুঃখ দুর্ভোগ তোমাকেই কাটিয়ে উঠতে হবে।
মা ছিল আমার সব ছিল, মা নেই আজ আমার কিছুই নেই। আজ যে আলোও আমাকে আলো দেয় না।
তোমাকে আলোও আলো দেয় না, এ শুধু তোমার মনোবলের অভাব। মনোবল সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তুমি মনোবল শক্ত করো। নিশ্চয় তুমি জয়ী হবে।
রেমার কথায় রবিন একটা সান্তনা পায়। রেমা রবিনের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে পাশে দাঁড়ায়। রেমার এই পাশে থাকা রবিনের শোক শক্তিতে পরিণত হয়। নিয়মিত রবিনের বাসায় এসে রান্না করা, পড়াশোনার দিকে খেয়াল করা— এসব এখন রেমার রুটিন।
রবিন দেখে ঘরে তার খাবার নেই। এদিকে তার পড়াশোনাও চালাতে হবে। একদিন সে কাজের সন্ধানে বের হলো। এসএসসি পাশে কী বা চাকরি পাবে। একটা খাবারের হোটেলে সে চাকরি পেল। সেখানে সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে। চাকরি হওয়াতে মহাখুশি রবিন— যাক, খেয়ে পরে তো বাঁচতে পারব, অন্ততপক্ষে পড়ালেখা চালাতে পারব। কোন কাজই কখনো ছোট নয়। এ কাজ আমাকে বাঁচার প্রেরণা দিচ্ছে। হয়তো আমি ক্লাস করতে পারব না, পরীক্ষার সময় পরীক্ষা তো দিতে পারব।
রবিন কলেজে একটা দরখাস্ত করল, ক্লাস না করেও পরীক্ষার সময় যাতে পরীক্ষা দেয়া যায় এই বিষয়ে।
কাজ থেকে সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় রবিন। সেদিন রেমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। একদিন রবিন রেমাকে বলল, আমার এ ছন্নছাড়া জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়ালাম, পারব কি তোমাকে সুখী করতে?
আমি আমার মনের হাহাকার দূর করেছি। মানুষ ভালোবাসে সুন্দর মনের মানুষকে। আমি সেই সুন্দর মন তোমার মাঝে পেয়েছি। আমি যে আর কোন সুখ চাই না, তোমার মাঝে পেয়েছি আমার ভালোবাসা।
পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আছো ভালোবাসার মানুষ তুমি। তোমাকে আমি হারাতে চাই না।
আমিও তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি আমি সবকিছুতে জীবন মরণ এক হয়ে থাকব। তুমি আমার জন্য, আমি তোমার জন্য।
তুমি আমার ভালোবাসা। কখনো হারিয়ে যেও না আমার জীবন থেকে।
যাবো না, যাবো না কখনো তোমায় একা রেখে।
এভাবে দুজন চলতে থাকে। দুজনে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করল। অনার্সে ভর্তি হলো ওরা।
পরিবারে রেমার বিয়ের কথা ওঠে। মা অহনা বললেন, বিকালে কিন্তু কোথাও যাস না রেমা।
কেন মা? বিকালে তো আমার কোচিং আছে।
ও তোকে তো বলা হয়নি। আজ তোকে দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ।
আমাকে দেখতে আসবে কেন মা?
রেমা, তুই বড় হয়েছিস। বিষয়টা তোকে বুঝতে হবে। আর সন্তানের জন্য কখন কী করতে হবে তা বাবা মা—ই ভালো জানে।
মা, আমার জন্য এখন তোমরা বিয়ের কথা ভেবো না। আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই।
সে তুই বিয়ের পরও পড়ালেখা করতে পারবি।
মা আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।
রেমার সোজা—সাপটা কথা শুনে মা চমকে যায়! মেয়েকে সন্দেহ করে। কিন্তু রেমা কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। কৌশলে এড়িয়ে যায়। অবশেষে একদিন মায়ের মন রক্ষার জন্য পাত্রপক্ষের সামনে হাজির হয়। ছেলেপক্ষ রেমাকে দেখে পছন্দ করল। রেমা এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রবিনের সাথে দেখা করল। কিন্তু রবিনকে কিছুই বলতে পারছে না।
রবিন বলল, কী ব্যাপার তুমি গম্ভীর হয়ে আছো কেন? কোন কথাই বলছো না যে?
রেমা মনে মনে ভাবে— কী করে যে বলি আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ছেলেপক্ষ আমাকে পছন্দও করেছে। কিন্তু কি যে করি, চাকরি করে যে টাকা তুমি পাও, তা তো তোমার পড়াশোনা আর থাকা খাওয়ায় চলে যায়। এ অবস্থায় তুমি আমার ভার কী করে নিবে?
এই তোমার কী হয়েছে? কিছুই বলছো না যে? রবিনের পুনঃ প্রশ্ন।
তোমার পাশে বসে আছি, আমার আজ অনেক ভালো লাগছে।
পাশে আছো পাশে থাকবে, এ আবার নতুন কী?
তোমার পাশে বসলে কখন যে সময় চলে যায় টেরই পাই না।
চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে, তোমাকে দিয়ে আসি।
আজ সপ্তম পর্ব প্রকাশ করা হলো
আগামী পর্ব দেখার জন্য অনুরোধ করা হলো