ফিরে এসো- লেখক সুলেখা আক্তার শান্তা (অষ্টমপর্ব)
বিনোদন ডেক্স
রেমা বাসায় এসে সুর পাল্টায়। সে বিয়ে করবে না বলে মাকে জানায়। ছেলেটার নাকি ব্যক্তিত্ব সংকট আছে। এমনিভাবে এক এক করে অনেক বিয়ে ভাঙলো। বাবা—মার কাছে বলে, এ ছেলের এ সমস্যা ও সমস্যা— সুন্দর না, দেখতে খাটো— ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখাতে থাকে রেমা। কিন্তু রবিনের কাছে কিছু বলে না। ভাবে, রবিন আগে প্রতিষ্ঠিত হোক। দেখাদেখির এক পর্যায় একটি ছেলে এলো। সে দেখতে অনেক সুন্দর, হ্যান্ডসাম। এবার কী করে বিয়ে থামাবে রেমা বুঝতে পারছে না। সবাই বলল, তুই তো আগে বলতি ‘এ ছেলে সুন্দর নয়, ও ছেলে ব্যক্তিত্বহীন’ — কিন্তু এ ছেলের তো কোন অংশ কম নয়, এবার তুই কী বলবি?
সবাই তো সবার কথা বলছে, রেমার কাছে রবিন শ্রেষ্ঠ সুন্দর। ওর যে সুন্দর একটা মন আছে। আর ভালোবাসবো একজনকে আর বিয়ে করব আর একজনকে, আমি তা পারব না।
দুদিন পরে রবিনের সাথে দেখা। রেমা বলল, রবিন চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি। তুমি আমাকে কুঁড়েঘরে রাখতে চাইলে আমি কুঁড়েঘরেই থাকব। আমার কোন রাজপ্রাসাদের দরকার নেই। কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ বিয়ের কথা বলছো!
আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
বিয়ে ঠিক হয়ে আছে! তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?
বলিনি এজন্য যে, আমি তোমার পরিস্থিতি জানি। তাই বলিনি।
আমাদের সামনে ফাইনাল এক্সাম। তোমার বাবা—মা নিশ্চয় জানেন? সে পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করুক।
মা বলে বিয়ের পরও পড়ালেখা করা যাবে।
আমি তাদের কাছে তোমার আমার কথা বলি?
আমার কিছু ভালো লাগছে না, আর তুমি কী বলবে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমরা বলে দেখি তাদের কাছে, তা নাহলে তারা জানবে কীভাবে আমাদের বিষয়টি?
জানি না তারা মানবে কিনা। তবে বলে দেখতে পারো।
আমার না ভয় ভয় করছে! আগে তো কখনো এরকম কাউকে বলিনি, তাই নার্ভাস লাগছে!
কেউ কখনো কোন ব্যাপারে বলে অভ্যস্ত হয় না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়।
ঠিক আছে আমি বলবো।
বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরবে ছ’টার দিকে। আগামীকাল তুমি চলে এসো, আজ তাহলে যাই।
পরদিন সন্ধ্যায় রবিন রেমার কথামতো রেমাদের বাসায় চলে এলো। এসে বেল টিপল। ভিতর থেকে কে বলতেই রবিন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তারপর বলল, আমি। দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। রেমার বাবা মি. আনান। বললেন— কাকে চাই?
রবিন সালাম দিয়ে বলল, আংকেল আমি আপনার কাছে এসেছি।
ভিতরে এসো, এখানে বসো। কিছু বলতে চাও?
হ্যাঁ।
বলো।
রেমার বিয়ের ব্যাপারে…।
মি. আনান রবিনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালো।
আংকেল, রেমা আর আমি একই সাথে পড়ি। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের বিয়ের কথা বলতে এসেছি।
পড়ালেখা নিশ্চয় করছো, শরম লজ্জা একটু থাকা দরকার ছিল। মেয়ের বাবার কাছে সরাসরি চলে এসেছো নিজের বিয়ের কথা বলতে। তোমার বাবা মা কোথায়?
আংকেল, আমার মা নেই আর বাবার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।
মা নেই সেটা দুঃখের বিষয়, কিন্তু বাবার সাথে যোগাযোগ নেই সে ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো এমন বাবা আমি নই। আর তুমি কর কি?
আমি একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি করি। আর তা থেকে যা পাই তা দিয়ে আমার পড়ালেখার খরচ চলে।
শোন, কোন বাবাই তার সন্তানের অমঙ্গল চায় না। তুমি এখন আসতে পারো। আর আমার মেয়ের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবে না।
রেমা আড়াল থেকে সব শুনলো। বাবার সামনে কিছুই করার ছিল না তার, শুধু দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। তারপর মায়ের কাছে গেল।
মা তোমরা কি আমার ভালো চাও?
সব বাবা—মাই তার সন্তানের ভালো চায়।
যদি তোমরা আমার ভালো চাও তাহলে যে ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো তা বন্ধ কর, আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি রবিনকে ভালোবাসি। আমি ওকে বিয়ে করব। সন্তানের চাওয়া পাওয়া তো থাকে বাবা—মা’র কাছেই। তোমরাই পারো আমার এ ইচ্ছা পূরণ করতে।
শোন, যা বলেছো আর যা ভাবছো এখানেই তা ভুলে যাও।
ভুলে যাবো আমি রবিনকে! মা আমি পৃথিবীতে বেঁচে থেকে এ যন্ত্রণার ভার সইতে পারব না।
পাগলামি করা যায়। কিক্ত কোন লাভ হয় না।
সন্তানের কাকুতি যদি বাবা—মা’র কাছে পাগলামি হয়, আমি না হয় সারা জীবন সে পাগলামি করে যাবো তোমাদের কাছে।
কয়েকদিন হয়ে গেল রবিনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না রেমা। বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ, বিয়ের দিনও ঠিক। শুক্রবার। রেমা একরকম গৃহবন্দি, নজরবন্দি। ফোনটাও এক অজুহাতে বাবা ব্যবহার করছে। বাসায় আত্মীয়—স্বজন গিজগিজ করছে। বুকের মধ্যে কান্নার ঢেউ। সে ঢেউ চোখে ছলছল করে। কোন অবলম্বন নেই। ঘুরে ফিরে সে বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। রেমা বাবার কাছে বলল, বাবা তোমরা আমার সবকিছু জেনেও অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করলে!
রাশভারী কণ্ঠে বাবা মি. আনান বললেন, যে ছেলে নিজের বাবার পরিচয় দিতে পারে না…।
না, বাবা এটা সত্য নয়। কে বলেছে রবিন নিজের বাবার পরিচয় দিতে পারে না? ওর বাবা নামকরা একজন বিজনেসম্যান— রায়হান সাহেব। আনান সাহেব চমকে ওঠেন। বলেন, ও রায়হান সাহেব। তা বলবি তো আমাকে। তাকে আমি চিনি তো। তা মা তুই রবিনকে বল ওর বাবাকে প্রস্তাব নিয়ে আসতে।
রেমা আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। মা মেয়ের মুখে হাসি দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। রেমা মুক্ত পাখির মতো রবিনের কাছে ছুটে গেল। রবিনকে কাছে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রবিন রবিন বাবা না…।
থামো থামো, আগে নিঃশ্বাস নাও। তারপর কথা বলো।
বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি হয়েছে।
রবিন অভিমান করে বলে, তোমার তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। তারিখ দেওয়া।
বাবা তোমার বাবার পরিচয় জানতে চেয়েছিল, আমি বলেছি তোমার বাবার কথা, বাবা তাকে চিনতে পেরেছে। তাই তাকে গিয়ে প্রস্তাব দিতে বলেছে।
তুমি তো জানো, বাবার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। আর যে বাবা দ্বিতীয় বিয়ের পর আমার আর মায়ের পাশে দাঁড়ায়নি, মৃত্যু আগে আমার মা তার স্বামীর কাছ থেকে চিকিৎসার টাকাটাও পায়নি, সে বাবার কাছে যাবো আমি? এরকম একজন বাবার পরিচয়ে যদি আমার বিয়ে থেমে যায়, তাহলে যাক।
রেমা ভাবল, সত্যিই তো, যে বাবা নিজের সুখের জন্য দূরে থাকল সে বাবার পরিচয় না দেয়াই ভালো। ঠিক আছে তুমি ভেবো না। আমি এ নিয়ে বাবার সাথে কথা বলব।
রেমা ফিরে এলো বাসায়।
বাবাকে বলল, রবিন ওর বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না। ও নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়।
ভালো কথা, সে যদি নিজে স্বাবলম্বি হতে পারে তাহলে তো ভালো। তবু এখন তো তার বাবাকে লাগবে। আমি কার কাছে আমার মেয়েকে তুলে দেবো? আমার মেয়ের দায়ভার কে নেবে? বাবা ছাড়া সন্তানরা কখনো স্থির হতে পারে না। যাক সেসব কথা। এত যখন ঝামেলা, রবিনের কথা বাদই দাও। তোমার বিয়ে তো ঠিক হয়ে আছে। তুমি সেদিকে প্রস্তুত থাকো।
বাবা, তুমি যখন জানলে রবিন রায়হান সাহেবের ছেলে তখন রবিনের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইলে। তোমার মেয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক থাকার পরও তোমার সিদ্ধান্ত তুমি পাল্টিয়েছিলে। সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু যখন বুঝলে তাদের বাবা ছেলে সম্পর্ক ভালো নয়। তখন তোমার মত পাল্টিয়ে গেল বাবা! তোমার এ মতভেদ আমার জীবনটাকে তছনছ করে দেবে বাবা। ঝরে যাওয়া ফুলকে কেউ কদর করে না বাবা…।
আহ্, বকবক করো না।
বাবা তোমরা মেয়েকে সুখী দেখতে চাও, কিন্তু মেয়ে যে কী পেলে সুখী হবে তা তোমরা বুঝতে চাও না। দেখি না তোমাদের সুখ আমাকে কতটা সুখী করতে পারে।
রেমার কথা শুনে মা ছুটে আসে। স্বামীকে বলে, দেখো মেয়ে যে রকম কথাবার্তা বলছে আমার ভালো লাগছে না। যা করো ভেবেচিন্তে করো।
আ হা, থামো তো তুমি।
তুমি বাবা, ভালোমন্দের দায়িত্ব তোমার থাকবে ঠিক আছে। কিন্তু আমিও তো ওর মা। আমার কি কিছুই বলার থাকতে পারে না? বলল অহনা।