ছোটগল্প “শেষ অধ্যায়”- সুলেখা আক্তার শান্তা
বিনোদন ডেক্স
সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র লীলা। সুন্দরী রুনা। অপূর্ব মুখশ্রী কিন্তু সেই মুখে নেই স্পষ্ট ভাষা। রুনার কথা বলায় জড়তা। সাধারণ ভাষায় তোতলা। দেখতে সুন্দরী হলেও ওই একটি মাত্র ত্রুটির কারণে তার ভাগ্যে বিরম্বনার শেষ নাই। বিয়ের ঘর আসে না এলেও ফিরে যায়। একদিন হঠাৎ একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র রিফাত গ্রামে থাকে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। রুনার পিতা সাজেদ আহমেদ মেয়ের বিয়ের ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বিয়েতে রাজি হললে পাত্র যা চায় সব কিছু দিয়ে বিয়ে দিবেন। আর না চাইলেও সবকিছু দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে দেবেন। পাত্র রিফাত ভাবি শ্বশুরের দিল দরিয়া মনোভাবে খুশি হয়। তার চাহিদা অনুযায়ী সব পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে সে রুনাকে বিয়ে করতে রাজি। রুনা রিফাতের বিয়ে হয়।
সাজেদ আহমেদ সপরিবারে দীর্ঘদিন যাবত ঢাকায় থাকেন। ঢাকাতেই তার ব্যবসা বাণিজ্য। রুনা ঢাকা শহরে বড় হলেও গ্রামের পরিবেশ তার খুব ভালো লাগে। শ্বশুর বাড়িতে ভালোই ভাবে মানিয়ে । তারপর শুরু হয় স্বামী ও শাশুড়ির আদেশ নির্দেশের পালা। কারো ঘরে যেতে পারবেনা, কারো সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। কাজ শেষ হলে নিজ ঘরেই থাকবে। কিন্তু রুনার সবার কাছে যেতে ইচ্ছা করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কারো সঙ্গে একটু কথা বলতে দেখলেই শাশুড়ি মর্জিনার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ঝামটা মেরে বলে, তোমাকে যে কথা বলছি মেনে চলো না কেন? সংসারের যাবতীয় কাজ, রান্নাবান্না, উঠান বাড়ি ঘর ঝাড়ু দেওয়া, শাশুড়ির গোসলের পানি এনে দেওয়া, কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়া সংসারের যাবতীয় রুনাকে করতে হয়। তারপর রাতে শোবার সময় শাশুড়ির গা হাত পা টিপে দেওয়া। স্বামী রিফাতের আবার হাত পা টিপে না দিলে ঘুম আসেনা। মা ছেলে দুজনেই মনে করে রুনার কোনো ক্লান্তি নেই। তাকে যা হুকুম করা হবে তাই সে করে যাবে। সরলমনা রুনাও ভাবে নিজের সংসার কাজ তো নিজেকেই করতে হবে। হাসিমুখে মেনে নিলে তাতে অন্তরে কখনো ব্যথা লাগেনা। শাশুড়ি মর্জিনা মুখ তো চলেই সঙ্গে তার হাতেও চলে। রুনাকে বকাঝকার সঙ্গে হাত দিয়ে ঠোকনা মারে।
সাজেদ আহমেদ মেয়েকে দেখতে আসে। সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে আসেন। বাজার ঘাট, কাপড় চোপড়, ফল, মিষ্টি। কোন কিছুতেই কমতি রাখতে চান না তিনি। মর্জিনা হেসে বলেন, বিয়ানসাব আপনি আসছেন তাতেই খুশি, এত কিছুর কি দরকার ছিল?
রুনা বাবাকে দেখে তাড়াতাড়ি রান্না করতে যায়। মর্জিনা বলেন, ভাইসাব মেয়েতো দিয়েছেন আমি তাকে বউ না মেয়ের মতো করে রাখতে চাই। কিন্তু আপনার মেয়ে আমার কোন কথা শোনে না। ইনিয়ে বিনিয়ে পুত্রবধূর দোষো কীর্তন করতে থাকে আবহমান ধারায়। সারাদিন আমাকে সংসারের কাজ করতে হয়। আমি বুড়া মানুষ হইয়া কাজ করি। তাও আপনার মেয়ে একটা কাজ ধরে না। সারাক্ষণ কার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়, হাসাহাসি করা যায়। এসব নিয়েই থাকে আপনার মেয়ে। আমি বৃদ্ধ মানুষ হইয়া রান্না করি, আপনার মেয়ে খায়! আমার তো মনে হয় মেয়েকে দিয়ে কোন কাজ কাম করাণ নাই। আর আদব-কায়দা শিখে নাই। দয়া কইরা আপনার মেয়েটাকে আমি বিয়ে করাইয়া আনলাম ছেলের জন্য। ভাবলাম তার একটা সমস্যা, সে মনে হয় নম্র ভদ্র হয়ে শ্বশুরবাড়ির মানুষের খেজমত করবে। না তা আর হলো না আপনার মেয়েকে দিয়ে! সাজেদ আহমেদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বলেন, বিয়ানসাব আপনি থামেন। আমি আমার মেয়ের ব্যাপারে ভীষণ লজ্জিত। মর্জিনা তার মধ্যেই বলেন, বিয়ানসাব আপনি যেরকম বিবেক-বুদ্ধিমান লোক তেমন কিন্তু আপনার মেয়ে হয়নি। যারা থাকবেন দূরে তাদের ব্যবহারে খুবই সন্তুষ্ট কিন্তু যে থাকবে আমার কাছে তার ব্যবহারে আমি খুবই অসন্তুষ্ট। আসছেন আরাম-আয়েশ করেন। রিফাতও মায়ের তালে তাল মিলিয়ে বলে, এবার বুঝেন আপনার মেয়েকে নিয়ে আমি কত জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে আছি। রুনার রান্না শেষ হয়, খাবার বেড়ে সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকে। সাজেদা আহমেদ বলেন, আমি এখন ঢাকায় চলি। রুনা বলে, বাবা তুমি কি বলছ? আসছো দু”দিন থাকবা তারপরে যাবা। না মা তোদের সবাইকে দেখার জন্য আছসি। আমার দেখা হয়ে গেছে এখন আমি চলি। যাবার সময় বলে যাই স্বামী-শাশুড়ির সেবা করিস। রুনা চোখমুখ একাকার করে আশ্চর্য হয়ে বলে, বাবা তুমি না খেয়ে এখন কোথায় যাবা?
মা আমি সেই দিনই তোর বাড়ি খাব যেদিন তোর শাশুড়ি স্বামীর সেবা করে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারবি।
বাবা তুমি না খেয়ে যেও না!
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেকে সংযত করে বলেন, মা আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
বাবা তোমার সঙ্গে আমাকে নিবা?
যেদিন জামাই বাবাজি আর বিয়ানসাব তোর সেবায় মন ভরবে আমাকে জানাবে, তোকে নিয়ে যাওয়ার কথা সেদিন বলতে আসবো। সাজেদ আহমেদ মেয়ের বাড়ি থেকে বের হয়। বাবার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রুনা। সাজেদা আহমেদ একবার পিছনে ফিরে তাকায় পরে আর তাকায় না।
রিফাত বউকে বিদ্রুপ করে বলে, বাবা এসেছে বলে আদরে গলে গেছে, বাবা আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাওনা। নিয়ে গেল না তোর বাবা তোকে? রুনা বলে, নিয়ে গেছে কিনা দেখতে পাচ্ছ না চোখে! রুনার এমন কথায় রিফাত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তুই আবার ত্যাড়ামি করে উত্তর দিস! তোরে খাইছি! রুনা ভয়ে দৌড়ে পালায়।
রুনা নিজের শরীরের কোন কিছুই বুঝতে পারেনা। তার কি হয়েছে বা কি হচ্ছে। নিজের শরীরের ব্যাপারে তার বোধ অনুভূতি খুব কম। আস্তে আস্তে তার শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে। তেমন একটা হাঁটাচলা করতে পারেনা। একটু কাজ করতেই হয়রান হয়ে যায়। পুকুর থেকে পানি আনে প্রায় বসে বসে। উঠান বাড়ি ঘর ঝাড়ু দেয় একটু বসে জিরিয়ে নেয়। না খেয়ে থাকলেও বলেনা সে ক্ষুধার্ত। খেলেও বলতে পারেনা সে খেয়েছে। বিছানায় শুয়েই রুনা ক্রমাগত বমি করতে থাকে। রুনাকে ছেলের বউ করে এনে কোনো ব্যাপারে কখনো না হাসলেও আজ হাসছে মর্জিনা। বলে ওঠেন, নাও ঘর উজ্জ্বল করতে আসছে নতুন অতিথি! রুনাও তাতে খুশি হয়। রুনা অসুস্থ ও পেটে সন্তান থাকলেও রিফাত রুনাকে কাজের হুকুম দেওয়া বন্ধ হয় না। এটা করতো ঐটা কর, একটার পর একটা ফরমায়েশ করেই যায়। এরপর রুনার এমন হয়েছে যে সে এখন বিছানা থেকে উঠে বসতে পারেনা। ওই অবস্থায় স্বামীকে বলে, আমাকে ডাক্তার দেখাও। আমি সুস্থ হলে মার কাজ করতে হবে না। তোমারও খাওয়া-দাওয়া কষ্ট হবে না।
রিফাত বলে, ডাক্তার দেখাবো! ডাক্তার দেখালে টাকা লাগে। সে টাকা দিবে কে? রুনা স্বামীর এমন কথার আর কথা বলে না। নির্জীব বিছানায় পড়ে থাকে। রুনাকে নড়তে-চড়তে তেমন না দেখে মর্জিনা ছেলেকে বলেন, বাঁচে কি মরে কে জানে? আমরা তার চেয়ে ওর বাবাকে খবর দেই। রিফাত ও তার মা সাজেদ আহমেদকে আসতে ফোন করে। বিয়াইনসাব আপনার মেয়ে আমারও আমার ছেলের খুব সেবা-যত্ন করে, আমরা তার ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট আপনি এবার এসে নিজ চোখে দেখে যান। সাজেদ আহমেদ খুশি মনে মেয়ের বাড়িতে যায়। এসে দেখে, বিয়ানসাব যা বলছে তার উল্টো চিত্র। মেয়ের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মর্জিনা বলেন, এবার আপনার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে যান। পারলে চিকিৎসা করান না পারলে না করেন। এমন ব্যায়রাম অওলা বউ দিয়ে আমার চলবে না। আমার ছেলেকে আমি বিয়ে করাবো। সাজেদ আহমেদ কোন তর্কে যান না। তিনি ভাবেন, মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায়। কিছু না পাওয়া গেলেও একটি ভ্যান পাওয়া যায়। পাড়ার কয়েকজন এসে বলে, আপনার মেয়েকে এই আগুনে রাখছেন কেন? আপনার কাছে আপনার মেয়ের নামে যে বিচার দিয়েছিল তার সবই মিথ্যা। কষ্ট চেপে রেখে সাজেদা আহমেদ বলেন, আমি জানি আমার মেয়ে কিরকম। তার নামে যে নালিশ দেওয়া হয়েছে সে ওরকম মেয়েই না। তারপরও সে শাশুড়ি। সেই দিকে বিবেচনা করে আমি মেয়েকে শাসিয়ে গেছি। সাজেদা আহমেদ রুনাকে ভ্যানে উঠাতে চায়। রুনা বলে, বাবা আমি যাব না। আমি যদি মরি এখানেই মরবো! মেয়েরা স্বামীর বাড়ি ঢুকে লাল শাড়ি পড়ে আর বের হয় সাদা কাপড় পড়ে। আমি যদি বের হই সাদা কাপড় পড়ে যেন বের হই। বাবা আমাকে একটু পানি খাওয়াবা। সাজেদা আহমেদ পানির গ্লাস মেয়ের মুখে ধরে। রুনা পানি খেয়েই একটা ঢেকুর তুলে অচেতন হয়ে পড়ে। সেই চেতনা আর ফিরে আসে না। অযত্ন অবহেলা বিনা চিকিৎসায় সে মৃত্যুবরণ করেন পেটে সন্তান নিয়ে। সাজেদ আহমেদের আর্তচিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মারে, বাবার সামনে সন্তানের মৃত্যুর নিদারুণ যন্ত্রণা আমি সইবো কেমনে। মর্জিনা ও রিফাতের মনে পড়ে রুনাকে যে জ্বালার যন্ত্রণা দিয়েছিল সেসব কথা। রিফাত কেঁদে বলে, আমি যদি রুনাকে ডাক্তার দেখাইতাম তাহলে আমার সন্তান পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখত। রুনাকে তার স্বামীর বাড়ি কবর দেওয়া হয়। সাজেদ আহমেদ শূন্য হাতে বাড়ি স্থানে ফিরে যায়। সুখের স্বপ্ন দেখা একটি সহজ সরল নারীর জীবনে যবনিকা নামে অনন্তকালের ধারায়।